ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের রাজধানী কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে কিছুদিন আগে এক নারী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যা ঘিরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মসনদে কাঁপন ধরেছিল। আরজি করে চিকিৎসক খুনের এই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে গড়ে উঠেছিল তুমুল আন্দোলন; যা ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতজুড়ে। আর এই আন্দোলনের শুরুর দিকে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ব্যবহার করা স্লোগান থেকে ‘অনুপ্রাণিত’ হয়।
পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা শুভেন্দু অধিকারী থেকে বামপন্থী সিপিএমের ছাত্র-যুব কর্মীরাও স্লোগান দিচ্ছিলেন—‘দফা এক, দাবি এক, মমতার পদত্যাগ।’ যেভাবে বাংলাদেশে স্লোগান উঠেছিল, ‘দফা এক দাবি এক, হাসিনার পদত্যাগ।’
সেই আরজি কর আন্দোলন এখন অতীত। নিস্তরঙ্গ। প্রায় শেষ। কিন্তু বাংলাদেশে এক হিন্দু সন্ন্যাসীকে গ্রেপ্তার, সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত নিপীড়নের অভিযোগকে ‘অস্ত্র’ বানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলগুলো নতুন করে আন্দোলনের রাস্তায় নামার ছক কষছে। আন্দোলনের রাজনৈতিক ফায়দার হিসেব-নিকেশ আঁচ করে শাসক তৃণমূলও অবস্থান নিয়েছে। তবে তা খানিক ‘এলোমেলো’ বলে দলেরই অনেকে মনে করছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক দিকে যেমন বলেছেন, তিনি বিদেশের (বাংলাদেশ) বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থানই মেনে নেবেন। তেমনই আবার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের দাবি তুলেছেন তিনি। অর্থাৎ রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটের সঙ্গে তার হিসাবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর অংকও যে নেই তা নয়। তিনি বারবার বলছেন, ‘‘আমরা সকলকেই ভালবাসি।’’
প্রত্যাশিতভাবেই বাংলাদেশকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মতো করে লাভের হিসেব কষতে শুরু করে দিয়েছে। বিশেষ করে বিরোধী পরিসরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর রাস্তায় নামা এবং আন্দোলনে থাকার ‘তাগিদ’ চোখে পড়ছে। বিশ্লেষকদের মতে, তাতে ‘অক্সিজেন’ দিচ্ছে বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমের একাংশের ভূমিকাও। তাতে যেমন স্বাভাবিক নিয়মে বিজেপি রয়েছে, তেমনই রয়েছে সিপিএম-কংগ্রেসও। আনুষ্ঠানিকভাবে অংকের কথা না মানলেও একান্ত আলোচনায় প্রত্যেক শিবিরের নেতারা তাদের ‘ফর্মুলা’র কথা গোপন করছেন না।
• পদ্মের অঙ্ক
২০১৯ সালের লোকসভা, ২০২১ সালের বিধানসভা কিংবা ছ’মাস আগে হয়ে যাওয়া আরও একটি লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির রাজনীতির মূল অস্ত্রই ছিল ‘মেরুকরণ’। তার সঙ্গে জুড়ে ছিল দুর্নীতি এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ। কিন্তু ২০১৯ সালে হঠাৎ পাওয়া সাফল্য পরবর্তী কালে আর ধরে রাখতে পারেনি তারা।
সেই বিজেপি বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর কথিত অত্যাচার নিয়ে সরব। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর পাশাপাশি তাদের সহযোগী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর নেতারাও ধারাবাহিক কর্মসূচি নিচ্ছেন। সমান্তরালভাবে চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারও। আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপি মুখপাত্র রাজর্ষি লাহিড়ী অবশ্য বলছেন, ‘‘আমরা কোনও লাভ-ক্ষতি দেখে রাস্তায় নেই। বাঙালি হিন্দুদের বিপন্ন অবস্থা আমাদের উদ্বিগ্ন করছে।’’
তিনি বলেন, ‘‘৫০০ বছর আগে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে যা হয়েছিল, ইসকনের সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণের সঙ্গেও তা-ই হয়েছে।’’
বিজেপির অনেক নেতা বলেছেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আবেগ রয়েছে। কলোনি এলাকার বহু মানুষ এই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারবেন। ফলে সঙ্ঘবদ্ধ করার প্রশ্নে কর্মসূচি করতে হচ্ছে। এ কথা ঠিক যে, গত কয়েকটি ভোটে বিজেপি যেমন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ‘হিন্দু-মুসলমান’ বা ‘৭০ শতাংশ-৩০ শতাংশ’র কথা বলেছে, তেমনই তৃণমূলও ‘বাঙালি অস্মিতা’কে জাগিয়ে বিজেপিকে ‘বহিরাগত’ প্রমাণ করার রাজনৈতিক আখ্যান তুলে ধরেছিল।
রাজ্যের বিরোধী দল বিজেপির কিছু নেতা বলছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ‘বিপন্নতা’ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন জারি রাখতে পারলে তৃণমূলের বাংলা ও বাঙালির রাজনীতিকে ‘ধাক্কা’ দেওয়া যাবে। তবে সে জন্য সাংগঠনিক জোর কতটা রয়েছে, তা নিয়েও সংশয়ের কথা গোপন করছেন না পদ্মশিবিরের প্রথম সারির নেতারা। কারণ, আন্দোলন আর ভোটবাক্সে তার প্রতিফলন যে ঐকিক নিয়মে হয় না, তা বিজেপি নেতাদের অজানা নয়।
আরজি কর আন্দোলনে যে নাগরিক ক্ষোভ আছড়ে পড়েছিল রাজপথে, শহরাঞ্চলে যার প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি, সদ্যসমাপ্ত উপনির্বাচনে তা কোনও ছাপ ফেলেনি। যদিও অনেকের মতে, বিজেপি যে ‘পাঠ্যক্রম’ মেনে রাজনীতি করে, তাতে আরজি কর আন্দোলন তাদের জন্য ‘উর্বর’ জমি ছিল না। তা মাসখানেকের মধ্যে প্রমাণিতও হয়েছে। বিজেপিও আস্তে আস্তে রাস্তা ছাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বিষয়ে ‘উপযোগী উপাদান’ রয়েছে বলে মনে করছেন পদ্মশিবিরের নেতৃত্বের বড় অংশ।
• শূন্যের অঙ্ক
বাংলার বিধানসভায় বাম-কংগ্রেস শূন্য। ভোট শতাংশেও তারা প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত। সেই দুই শক্তিও অংক কষেই বাংলাদেশ নিয়ে রাস্তায় নামছে। সিপিএম সরাসরি বলছে না যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। তারা সচেতনভাবে বলছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা ‘নির্যাতিত’। একই সঙ্গে ভারত, ফিলিস্তিনও জুড়ে দিচ্ছে।
যার অর্থ আন্তর্জাতিকতাবাদকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া। কিন্তু সিপিএম নেতারা যে অঙ্ক কষছেন, তা হল হিন্দু ভোট। বিশেষ করে কলোনি এলাকার হিন্দু ভোট। যা এক সময়ে ছিল সিপিএমের ‘শক্ত ঘাঁটি’। কিন্তু বিজেপির আগ্রাসী রাজনীতির সামনে সেই ঘাঁটি কার্যত তছনছ হয়ে গেছে। বামের ভোট ধাপে ধাপে চলে গেছে রামের বাক্সে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে রাস্তায় নেমে সেই ক্ষতেই প্রলেপ দিতে চাইছেন বামরা। ৬ ডিসেম্বর প্রতি বছর ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দিবস’ পালন করে বামরা। ১৯৯২ সালের ওই দিনে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। এবার ৬ ডিসেম্বর কলকাতায় সিপিএম যে মিছিল করতে চলেছে, তার বিষয় ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদ।’
পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার বলছে, ‘‘একটা সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম ভোটের সিংহভাগ ছিল বামেদের দখলে। ২০০৯ সাল থেকে সেই ভোট ঢলে পড়েছিল মমতার দিকে। ক্রমে সেই ভোটই এখন তৃণমূলের পুঁজিতে পরিণত। আর হিন্দু ভোট টেনে নিয়েছে বিজেপি। যার ফলস্বরূপ জামানত রক্ষা করাই দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে বাম-কংগ্রেসের।’’
‘‘মুসলিম ভোট ভাঙার ক্ষেত্রে অবশ্য কৌশল নিয়েছিল সিপিএম। ফুরফুরা শরিফ, আব্বাস সিদ্দিকি, নওশাদ সিদ্দিককে সামনে রেখে ভোট ভাঙার সেই কৌশল সফল হয়নি। বরং মালদহ, মুর্শিদাবাদের মতো যেসব জেলায় কংগ্রেসের সঙ্গে কিয়দংশ মুসলিম ভোট ছিল, তা-ও চলে গেছে তৃণমূলের ঘাঁটিতে।’’
কংগ্রেসও বাংলাদেশ নিয়ে কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে। বেলঘরিয়ার যে তরুণ বাংলাদেশে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন, সেই সায়ন ঘোষের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে এসেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার-সহ দলের অন্যান্য নেতারা। ফলে এটা স্পষ্ট যে, কংগ্রেসও বিরোধী পরিসরে বিজেপির সমর্থনে থাবা বসানোর কৌশল নিয়েই বাংলাদেশ নিয়ে ‘সক্রিয়’ থাকার চেষ্টা করছে।
যদিও কংগ্রেসের তরুণ নেতা আশুতোষ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘বিজেপি সীমান্তে গিয়ে উত্তেজনা তৈরি করছে। কিন্তু বেলঘরিয়ায় যায়নি। তার কারণ একটাই—সায়ন বাংলাদেশে যে বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলেন, তিনি ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম। সেই পরিবার সায়নকে আগলে রেখেছিল। সায়নের বন্ধুই তাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গেদে সীমান্তে পৌঁছে দিয়েছিলেন। বিজেপি সেটা বিপণন করতে পারবে না। তাই সায়নের বাড়িতে যায়নি।’’
• তৃণমূলের হিসেব-নিকেশ
বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের দলগত অবস্থান আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। তার বক্তব্য, বিদেশের ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকার যা অবস্থান নেবে, সেটাই তৃণমূলের অবস্থান।
মমতা দাবি করেছেন, জাতিসংঘের সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশে ‘শান্তিরক্ষী’ পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করুক ভারত সরকার। এভাবে শান্তিসেনা পাঠানো যায় কি না বা কূটনৈতিক স্তরে তেমন সুযোগ রয়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে তৃণমূল দলগত অবস্থান স্পষ্ট করার পরও বাংলাদেশের বিষয়ে মন্তব্য করছে।
বুধবার তৃণমূলের মুখপত্রে প্রতিবেদনের শিরোনামে লেখা হয়েছে, ইউনূস সরকারের অসভ্যতা চলছে।’’ তৃণমূলও ‘কড়া’ কথা বলছে অংক কষেই। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন এই দলের প্রথম সারির একজন নেতা বলেছেন, ‘‘আমরা যদি এই অবস্থান না নিই, তা হলে বিজেপি হিন্দু ভোটে আরও মেরুকরণ করার চেষ্টা করবে। সেই সুযোগ ওদের দেওয়া হবে কেন?’’
তৃণমূলের নেতারা বলছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ালে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, তারা ভালো করে জানেন, মমতার শাসনেই তারা নিরাপদ। সীমান্তবর্তী এলাকায় বিজেপি যাতে ‘উস্কানি’ না দিতে পারে, সে দিকেও সাংগঠনিকভাবে খেয়াল রাখতে হচ্ছে বলে দাবি দলটির নেতাদের।
সূত্র: আনন্দবাজার।