Shadhin24news.com

রাত ৮:৫৩ , সোমবার , ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ, ১৪৩১
সর্বশেষ সংবাদ

কাঙ্ক্ষিত মাছ ধরা পড়ছে না সাগরে, লোকসানে জেলে-মৎস্য ব্যবসায়ীরা

নিষেধাজ্ঞা শেষে জেলেদের জালে ইলিশসহ ঝাঁকে ঝাঁকে সামুদ্রিক মাছ ধরা পড়ার কথা থাকলেও পাল্টে গেছে বর্তমান চিত্র। মাত্র এক মাস আগে মা ইলিশ রক্ষায় সরকার নির্ধারিত ২২ দিনের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেও সাগরে গিয়ে জেলেদের জালে মিলছেনা কাঙ্ক্ষিত মাছ।

এতে একদিকে যেমন জেলেরা জড়াচ্ছেন ঋণের জালে, তেমনি  লোকসানে পড়েছেন ঘাটে থাকা বিভিন্ন মৎস্য ব্যবসয়ীরা। এ ছাড়া মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে মাছ সরবরাহ কম হওয়ায় কমেছে ঘাট থেকে সরকারের রাজস্ব আদায়।

সরেজমিনে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য অবতরণকেন্দ্র বিএফডিসি ঘাট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সাগর থেকে মাছ শিকার শেষে দিনে ও রাতে বিভিন্ন সময়ে একের পর এক ট্রলার নিয়ে ঘাটে ফিরছেন সমুদ্রগামী জেলেরা। তবে সাগরে গিয়ে কাঙ্খিত মাছ না পাওয়া অনেকটা খালি ট্রলার নিয়েই তীরে ফিরছেন তারা। আর ঘাটে মাছ কম আসায় এক প্রকার বেকার সময় পার করছেন ঘাটে থাকা মাছ উত্তোলন শ্রমিকরা।

মাছ শিকার করতে সমুদ্রে গিয়ে এক সপ্তাহ বা তার অধিক সময়ের জন্য ছোট-বড় আকারভেদে প্রতিটি ট্রলারে ৩  থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু সাগর থেকে ফিরে এসে অধিকাংশ ট্রলারের ওই খরচ পরিমাণ মাছ বিক্রি হয়না। ফলে ফিরে আসা ট্রলারগুলোর মালিক ও জেলেদের পরবর্তী সমুদ্র যাত্রায় অনীহা তৈরি হয়েছে। এরপরও যারা মাছ শিকারে যাচ্ছেন প্রতি ট্রিপেই বাড়ছে তাদের ঋণের বোঝা। এ-সব ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, পরিবারের ভরণপোষণ নিয়েই এখন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বরগুনার সমুদ্রগামী জেলেরা।

সাগর থেকে মাছ শিকার করে ঘাটে ফিরে আসা জেলে মোঃ ইমরান বলেন, “সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে ২২ দিন মা ইলিশ রক্ষায় মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে গিয়ে ১৩ দিন ছিলাম। সাগরে মাছ শিকার করতে গেলে স্বাভাবিকভাবে আমাদের প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ হয়। তবে এ টাকা খরচ করে ১৩ দিন পর ঘাটে এসে মাত্র ১ লাখ ৪২ হাজার টাকায় মাছ বিক্রি করতে পেরেছি আমরা।”

মোঃ শিপন নামের আরেক জেলে বলেন, “মাছ শিকার করতে ট্রলার নিয়ে জেলেরা সাগরে যায়, কিন্তু পর্যাপ্ত মাছ পায়না। একেকটি ট্রলার সাগরে যেতে প্রায় তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু মাছ শিকার শেষে ঘাটে এসে মাছ বিক্রি হয় ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায়। এতে জেলেদের বাড়ছে ঋণের পর ঋণ। এ ছাড়া অনেক জেলেরা আড়ত থেকে নেয়া দাদনও পরিশোধ করতে পারছেন না।”

পাথরঘাটা বিএফডিসি ঘাট থেকে পাইকারি মাছ কিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করেন মোঃ ইউসুফ, তিনি বলেন, “নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে গিয়ে প্রতিবছর বেশি মাছ পেলেও এবছর তুলনামূলক মাছ কম। ট্রোলিং জাহাজ দিয়ে সাগরে মাছ শিকার করার কারণেই সাধারণ জেলেরা এ বছর মাছ পাচ্ছেননা। গত ২২ দিন অবরোধে ইলিশ যে ডিম ছেড়েছে বলতে গেলে তাও ধরা পরে এ ট্রলিং জাহাজে। এতে বর্তমানে সাগরে ইলিশ নেই বললেই চলে। এরকম চলতে থাকলে জেলে পেশায় ভবিষ্যতে কেউ আর থাকবে না।”

পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর নিষেধাজ্ঞা শেষে নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর এই এক মাসে বিএফডিসি ঘাটে মোট মাছ নেমেছিল  ৪৬১.৯৪ মেট্রিকটন। যার মধ্যে ইলিশ ১৬৭.৪ এবং মিশ্রিত মাছ ২৯৪.৯০ মেট্রিকটন। এ তুলনায় একই সময়ে এ বছর এখন পর্যন্ত বিএফডিসি ঘাটে মোট মাছ নেমেছে ৩৮৪.৮১ মেট্রিকটন। এর মধ্যে ইলিশ ১১০.৩৫ মেট্রিকটন এবং মিশ্রিত মাছ ২৭৪.৪৬ মেট্রিকটন।

এ হিসেব অনুযায়ী গত বছর নিষেধাজ্ঞা শেষে একমাসে ঘাটে নামা মোট মাছের তুলনায় এ বছর ৭৭.১৩ মেট্রিকটন কম মাছ অবতরণ হয়েছে। এতে গত বছর এই সময়ে মৎস্য অবতরণকেন্দ্র বিএফডিসি ঘাট থেকে সরকারি রাজস্ব আদায় হয়েছে ২০ লাখ ৭৮ হাজার ৭৬০ টাকা, যা এবছর প্রায় ৪ লাখ টা কমে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার ৪৮৫ টাকা। ফলে মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের মাছের অবতরণ কম হওয়ায় মাছের দাম বৃদ্ধিতে লোকসান গুনতে হচ্ছে ঘাটে থাকা মৎস্য ব্যবসায়ীদের। অপরদিকে লোকসানে পড়ে ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন সমুদ্রগামী অসংখ্য জেলেরা।

পাথরঘাটা বিএফডিসি ঘাটের মৎস্য ব্যবসায়ী মোঃ ইসলাম বলেন, “আড়তে ১০ থেকে ১২ জন লোক নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে এখন হিমসিম খেতে হচ্ছে। বর্তমানে আমরা অনেক লোকসানে আছি। আমরা ছোট ব্যবসায়ী, তবে যারা বড় ব্যবসায়ী তারা এবছর কোটি টাকার লোকসানে পড়েছে। অসংখ্য ট্রলার সাগরে না গিয়ে ঘাটে বাঁধা অবস্থায় আছে। কারণ সাগরে গেলে যে পরিমাণ মাছ পাওয়া যায় তা বিক্রি করে খরচ টাকাই পাওয়া যায়না।”

মোঃ আব্দুল জব্বার মাঝী নামের আরেক মৎস্য ব্যবসায়ী বলেন, “সরকার নির্ধারিত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে যে পরিমান মাছ ঘাটে আসার কথা তার ১৬ ভাগের এক ভাগও আসেনি। বিশেষ করে ট্রলিং জাহাজের কারণেই জেলেদের জালে কম মাছ ধরা পড়ছে। অবরোধ শেষে মাছ শিকার করতে সাগরে গিয়ে প্রতি ট্রলারের জেলেরা এখন প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা ঋণী হয়েছে। অনেকে আবার সাগরে যাবেনা বিধায় ট্রলার থেকে জাল দড়িও খুলে রেখে দিয়েছেন।”

আরেক মৎস্য ব্যবসায়ী মোঃ রুহুল আমিন বলেন, “মাছ না পাওয়ায় একদিকে জেলেরা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তেমনি আমরা ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। জেলেরা পর্যাপ্ত মাছ শিকার করে নিয়ে আসতে না পারলে আমরা মাছ পাবো কোথায়? কম মাছ নিয়ে আসায় আমাদের বেশি দামে মাছ কিনতে হলেও মোকামে বিক্রি করতে হচ্ছে কম দামে। এ কারণে জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ী উভয়ই আমরা বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি।”

গত বছরের তুলনায় এবছর কি কারণে জেলেদের জালে কম মাছ ধরা পড়ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বর্তমানে সাগরে ট্রলিং জাহাজে মাছ শিকার বেড়েছে। এতে ছোট মাছও রক্ষা পায়না। ফলে সাগরে ইলিশ বড় হওয়ার কোনো সুযোগ পায়না। আর এ কারণেই গত বছরের তুলনায় এবছর অবরোধের পর এখন পর্যন্ত জেলেদের জালে মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ মাছ ধরা পড়েছে।”

পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লেঃ কর্নেল জিএম মাসুদ শিকদার বলেন, “জেলেরা সাগরে গিয়ে তেমন মাছ পাচ্ছেন না। ফলে বলা চলে তারা খালি হাতে সাগর থেকে ফেরত আসছেন। এতে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে মাছের অবতরণ কম হচ্ছে, ফলে সরকারের রাজস্ব আদায়ও কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমানে সাগরে ইলিশ নেই বললেই চলে। আশাকরি খুব দ্রুতই আমাদের এ সংকট কেটে যাবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ